এম মতিউর রহমান মামুনঃ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে অবহেলিত জনপদ নওগাঁ জেলায় একটি পূর্ণঙ্গ পাবলিক বিশ্ববিদ্যাল ঘোষণা করে আমাদের ঋণী করছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালির জন্মশতবার্ষিকী আমরা যখন পালন করছি তখন আরেক জন শ্রেষ্ঠ বাঙালি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চারণভূমি নওগাঁর পতিসরেই বিশ্ববিদ্যালয় করা হোক, দেশের সুশিল সমাজ তাই চান। কেননা বঙ্গবন্ধু কন্যা সাজাপুরে ‘রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ’ করেছেন, শিলাইদহেও করেছেন, বাঁকি আছে শুধু রবিতীর্থ হিসাবে খ্যাত নওগাঁর পতিসর। তাই মুজিববর্ষে পতিসর বাসীর এমন চাওয়া অমূলক নয়, কারন তিনি (প্রাধানমন্ত্রী) শিলাইদহের ‘মা’ সাজাপুরের মা পতিসরের ও ‘ মা’, বিধায় আমরা মায়ের শ্নেহ ভাগ করতে চাইনা বরং লক্ষ লক্ষ সন্তানতের পক্ষে মায়ের কাছে প্রার্থনাই করতে চাই।
বলে রাখা দরকার রবীন্দ্রনাথ নিভৃত পল্লী পতিসরে শিক্ষার কাজ হাতে নিয়ে সফল হয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই শান্তিনিকেতনের মতো ঘোরপল্লী বীরভূমে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলেছেন। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ নিজেই যেখানে পল্লীতে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান করছেন তাহলে আমাদের করতে আপত্তি কোথায়? পতিসর আমাদের ইতিহাস।
প্রজাদের সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কারন ১৮৯১সালের ১৩ জানুয়ারী নিজ জমিদারি পতিসরে এসে কবি চারিদিকে ঘুরে ফিড়ে বেড়িয়েছেন, যেমন নাগর নদীতে ভেসে তেমনি নাগর নদীর পাড়ে, মাঠে এবং আসে পাশে হেটে। সে দেখার অভিজ্ঞতা নিঃশব্দে প্রভাব ফেলেছে কবির অন্তরে, তাই তাঁকে বলতে শুনি ‘তোমরা যে পার যেখানে পার এক-একটি গ্রামের ভার গ্রহণ করিয়া সেখানে গিয়া আশ্রয় লও। গ্রাম গুলিকে ব্যবস্থাবদ্ধ করো। শিক্ষা দাও, কৃষি শিল্প ও গ্রামের ব্যবহার-সামগ্রী সম্বন্ধে নতুন চেষ্টা প্রবর্তিত করো’ (রবীন্দ্ররচনাবলী ১০ম খন্ড পৃঃ ৫২০-২১)। এ প্রভাব তার মানবিক চেতনাকে উদ্দীপ্ত করেই সম্ভবত তাকে সাধারণ মানুষের, দুস্থ গ্রাম্য চাষির জটিল সমস্যা জীবনের গভিরে নিয়ে গেছে স্বাভাবিকতায়।
এমনি এক আত্মিক সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ চরম সত্য উপলব্ধি করে বুঝতে পারেন এই এলাকার প্রজা চাষীদের দুঃখ দুর্দশার প্রধান কারণ অশিক্ষা। অন্য দিকে নিজ জমিদারি কালীগ্রামের সহজ সরল অল্প আয়ের সল্প শিক্ষিত মানুষ গুলোর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা অনুভবের মধ্যে দিয়ে কবি লিখেছেন ‘কোথায় প্যারিসের আর্টিস্ট-সম্প্রদায়ের উদ্দাম উন্মত্ততা আর কোথায় আমার কালীগ্রামের সরল চাষী প্রজাদের দুঃখ দৈন্য-নিবেদন!…এদের অকৃতিম ভালোবাসা এবং এদের অসহ্য কষ্ট দেখলে আমার চোখে জ্বল আসে।…বাস্তবিক এরা যেন আমার একটি দেশ জোরা বৃহৎ পরিবারের লোক” (ছিন্নপত্রাবলি ১১১সংখ্যক চিঠি) সেই উপলব্ধি থেকে প্রায় গ্রামে গ্রামে অবৈতনিক পাঠশালা উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপনের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ এই অঞ্চলের শিক্ষার ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করেন। অপর দিকে মৃত্যুর তিন বছর পূর্বে পতিসরে উচ্চশিক্ষার প্রয়াস ব্যক্ত করে বলেছেন “সংসার থেকে বিদায় নেওয়ার পূর্বে তোমাদেরকে দেখার ইচ্ছা ছিল তা আজ পূর্ণ হল। তোমরা এগিয়ে চল — জনসাধারণের জন্যে সবার আগে চাই শিক্ষা — এডুকেশন ফাস্ট, সবাইকে শিক্ষা দিয়ে বাঁচাও”।
সেদিক থেকে বিবেচনা করে পতিসরবাসীর দীর্ঘদিন থেকে যে, দাবি তুলেছেন তা অযৌক্তিক নয়। পতিসর বাসীর চাওয়াকে সমর্থন জানিয়ে গণমাধ্যকে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া বলছেন, ‘নওগাঁর পতিসরে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি যুক্তিসঙ্গত প্রধানমন্ত্রী সদয় হলে নওগাঁয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন সম্ভব হবে।’ তিনি এই দাবি বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার কথাও জানিয়েছেন। আমরাও তাঁর সঙ্গে একমত এবং আশাবাদি যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথের পতিসরের প্রতি সন্মান জানিয়ে ‘রবীন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় করবেন।
ইতিমধ্যেই নওগাঁতে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় করার কথাই বলেছেন ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের গবেষকগণ। এবং বিভিন্ন গবেষণাতে উঠে এসেছে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে উত্তরাঞ্চলের কৃষিখাত অনেকটা হুমকির সম্মুখীন এবং তা মোকাবেলার জন্য এই এলাকার মাটির গঠন, পানির স্তর, জলবায়ু নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণের সমন্বয়ে কৃষিখাতের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন অপরিহার্য। যার সুবিধা শুধু উত্তরবঙ্গ নয় দেশের সামগ্রিক কৃষিখাতকে আরও উৎপাদনশীল করতে সহয়তা করবে। স্বাভাবিকভাবেই এই এলাকায় একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে গবেষণার যেমন সুযোগ ঘটবে তেমনি শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি কৃষি উৎপাদনেও যুগান্তকারি অধ্যায়ের সূচনা হবে। স্বপ্নটা দেখেছেন খোদ রবীন্দ্রনাথ নিজেই, তাই পতিসরের স্বল্প আয়ের অল্পশিক্ষিত প্রজা চাষিদের আধুনিক চাষে প্রবৃত্ত করে নিজ পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠকুর ও জামাতাকে কৃষিতে উচ্চশিক্ষা জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ইলিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিয়ে কলের লাঙল সহ পতিসরে আধুনিক কৃষির কাজে নিয়োজিত করেছিলেন। তাই পরিস্কার বলা যায় পতিসর যে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি উঠেছে তা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেখান পথ ।
পতিসরে বিশ্ববিদ্যালয়ের করার মতো প্রয়োজনীয় জায়গা জমি রবীন্দ্রনাথ নিজেই রেখে গেছেন। বিশাল এলাকা জুড়ে রবীন্দ্রনুরাগী সাংসদ ইসরাফিল আলম কর্মপরিকল্পনা হাতেও নিয়েছেন । তার চেয়ে বড় কথা শিলাইদহ ও শাহজাদপুর যদি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য রচনার মর্ত্যভূমি হয়ে থাকে, তাহলে কালীগ্রাম পরগনার পতিসর ছিল সাহিত্য রচনা ও গ্রাম উন্নয়ন, পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাবিস্তারের মডেল ভূমি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজ থেকে একশ’ বছর পূর্বে পতিসরে এসে বুঝতে পেরেছিলেন গ্রামের হতদরিদ্র, অসহায়, অশিক্ষিত মানুষকে শিক্ষিত করতে না পারলে আলোকিত ক্ষুধামুক্ত সমাজ গঠন সম্ভব নয়। সে কারণে কালীগ্রামে (১৯০৫ সালে) গড়ে তুলেছেন কৃষি সমবায় ব্যাংক, হিতৈষী সভার উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন গ্রামে গ্রামে অবৈতনিক পাঠশালা, বিভাগের মধ্যে ইংরেজি ও কেন্দ্রে উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় । পতিসরে পুত্রের নামে ‘কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশন’ স্থাপন করে আর্শিবাণীতে লিখলেন “রথীন্দ্রনাথের নাম চিহ্নিত কালীগ্রামের এই বিদ্যালয়ের আমি উন্নতি কামনা করি। এখানে ছাত্র এবং শিক্ষকদের সম্বন্ধ যেন অকৃত্রিম স্নেহের এবং ধৈর্য্যের দ্বারা সত্য ও মধুর হয় — এই আমার উপদেশ। শিক্ষাদান উপলক্ষে ছাত্রদিগকে শাসন পীড়নে অপমানিত করা অক্ষম ও কাপুরুষের কর্ম — একথা সর্ব্বদা মনে রাখা উচিত। এরূপ শিক্ষাদান প্রণালী — শিক্ষকদের পক্ষে আত্মসম্মানের হানিজনক। সাধারণতঃ আমাদের দেশে অল্পবয়স্ক বালকগণ প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষকদের নির্মম শাসনের উপলক্ষ্য হইয়া থাকে — একথা আমার জানা আছে। সেই কারণেই সতর্ক করিয়া দিলাম।”
মূল লক্ষ্য ছিল যথাযথ শিক্ষাদানের মাধ্যমে গ্রামবাসীর মানসিক উন্নতি ঘটানো, সে সঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নিশ্চয়তার বিধান। ঢাকার ছাত্র-জনতার উদ্দেশে এই সমাজ ভাবনার কথাই বলেছিলেন বেশকিছু কাল পর (১৯২৬ সালে )।
এবং মৃত্যুর কয়েক বছর আগেও বলেছেন, ‘শ্রেষ্ঠত্বের উৎকর্ষে শিক্ষা সকল মানুষের অধিকার। গ্রামে গ্রামে মানুষকে সেই অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। সকলের চেয়ে বড় দরকার শিক্ষার সাম্য’ (পল্লীপ্রকৃতি)। এক কথায় তার পূর্বাপর লক্ষ্য গ্রামবাসীর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানসিক উন্নয়ন এবং গ্রাম ও নগরের বৈষম্য হ্রাস করা, গ্রাম যেন শহরের উচ্ছিষ্টভোজী না হয়। সে লক্ষ্যে নিজস্ব জমিদারির ২৩০ বর্গমাইল আয়তনের কালীগ্রাম পরগনার ৬০০টি গ্রামের সাধারণ মানুষের শিক্ষার কথা বিবেচনা করে অবৈতনিক পাঠশালা চালু করেন।
একথা সত্য যে, সীমিত পরিসরে রবীন্দ্রনাথের গ্রাম উন্নয়ন পরিকল্পনা পতিসরে সফল হয়েছিল। তার লক্ষ্য ছিল, গ্রামে গ্রামে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা নিশ্চিত করা, আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষির উন্নতি ও কুঠির শিল্পের বিকাশ ঘটানো এবং বিকল্প বা উদ্বৃত্ত অর্থের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর গ্রাম গড়ে তোলা; যা তিনি কালীগ্রাম পতিসর থেকেই শুরু করেছিলেন।
বিধায় রবীন্দ্রনাথের গ্রামোন্নয়ন ও শিক্ষা বিস্তারের মডেল ভূমি হিসাবে খ্যাত রবিতীর্থ পতিসরে রবীন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় করতে পারলে বহিঃবিশ্বে বাংলাদের সন্মান ও মর্যদা বহুঅংশে বৃদ্ধি পবে।
রবীন্দ্রনাথ পতিসরে যায়গা জমি রেখেই গেছেন, দরকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুচিন্ত মতামত ও সিদ্ধান্ত। কারন বর্তমান মন্ত্রিপরিষদে পতিসরে রবীন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের যৌক্তিকতা কেউ তুলে ধরছেন কি না জানিনা। তবে অতীতে একবার বেশ জোর দিয়েই বলেছিলেন একসময়ের আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা, বাণিজ্যমন্ত্রী মরহুম আবদুল জলিল। তিনি পতিসর আলাদা উপজেলা করারও প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন, এবং বর্তমানে বলছেন রবীন্দ্র অনুরাগী সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলম সহ ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের কিছু মুক্তমনের শুভ বুদ্ধির মানুষ। তাঁদের কথা বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে পতিসরে বিশ্ববিদ্যালয় করলে বঙ্গবন্ধু কন্যা আজীবন সমাদ্রিত হবেন।
রবীন্দ্রস্মৃতি সংগ্রাহক ও গবেষক।